আমাদের সুপারম্যান-০৪

by admin
66 views

ধারাভাষ্যে সম্ভবত তখন নাসের হুসেইন। ৯৯তে দাঁড়িয়ে তিনি, ভয়-ডর ভুলে এ্যাডাম মিলনের শর্ট বলটাকে কিপারের মাথার উপর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সীমানা দড়ির ওপারে। ছয়। মাক্রোফোনে গমগম কন্ঠে বলে উঠলেন নাসের, “হি ইজ দ্য সুপারস্টার অব বাংলাদেশ ক্রিকেট। এন্ড হি প্লেইড লাইক এ সুপারস্টার, টুডে।”

টিভি সেটের এপ্রান্তে আমাদের চোখের জল আটকে রাখা দায়! তিনি শুধু সেদিন নয়, আরো অনেকবার আমাদের চোখে এমন বাঁধভাঙা জলের উপলক্ষ্য সৃষ্টি করেছেন। আনন্দে আত্মহারা হওয়ার উপক্রম হয়েছে আমাদের।

আমরা তাঁর অতিমানবীয় কীর্তির স্বীকৃতি দিতে তাঁকে আমাদের ‘সুপারম্যান’ অভিধায় ভূষিতও করেছি। আজকের গল্পটা আমাদের সুপারম্যানের তেমনই কোনো এক ‘সুপারম্যান’ শো নিয়ে।ীহ পুরো লেখায় কোথাও আমরা তাঁর নাম নেবো না, বলবো না কোন সময়ের কোন ম্যাচের গল্প বলা হচ্ছে; আমরা শুধু তাঁর কোনো এক সময়ের অতিমানবীয় কীর্তির স্মৃতিচারণা করবো।

_________

তিনি নির্লিপ্ত। উদাসীন। ভাবাবেগহীন। চারপাশের কোনো কিছু নাকি তাঁকে স্পর্শ করে না। তিনি তাঁর গন্ডীতে, তাঁর পরিমন্ডলে, নিজস্ব এক জগতে বাস করেন। যেখানে অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। মানবীয় আবেগ, অনুভূতির উর্ধ্বে নাকি তাঁর বোধ, অনুভূতি! তাই কি?

তাহলে সেদিন তাঁর ব্যাট অমন চওড়া কি এমনি এমনিই হয়েছিল? মাস কয়েক আগের বেদনাকাতর কোনো স্মৃতি তাঁর স্মৃতিপটে ছিল না? অমন খুনে মেজাজের ব্যখ্যা কি পুরোটাই ক্রিকেটীয়? সমস্ত শক্তি পুঞ্জিভূত করে, প্রতিপক্ষকে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার কোনো সংকল্প কি তাঁর ছিল না? সেদিনের ‘তিনি’ কি অন্যদিনের ‘তিনি’ই ছিলেন?

বলা কঠিন!

আমাদের সুপারম্যান  ০১ পড়ুন! 

আগের ম্যাচেই ধুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। ম্যাককালাম দাঁড়িয়ে গেলে, কোনো দলেরই কিচ্ছু করার থাকে না। বাংলাদেশেরও ছিল না। ম্যাককালাম-তান্ডবে ন্যুনতম প্রতিরোধটুকুও দেখানোর শক্তি ও সাহস দুটোই হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ।

পূর্বেকার দুই আসর থেকেই শূণ্য হস্তে বিদায় ঘটেছে। সেই কবে প্রথম বিশ্ব টি-টুয়েন্টিতে ক্যারিবীয়ান সুখস্মৃতি পেয়েছিল বাংলাদেশ। তারপর আইরিশ লজ্জা উপহার পেলেও, আর কোনো জয় পাওয়া হয়নি। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠেয় বিশ্ব টি-টুয়েন্টির সম্ভাব্য পরিণতিও বুঝি তাই! অসহায় আত্মসমর্পণেই হয়তো বিদায় ঘটবে, আরো একটি বিশ্ব আসর থেকে।

তিনি একটু অন্যরকম ভাবছিলেন হয়তো। প্রতিপক্ষ দলটিকে দেখে হয়তো সংকল্পও স্থির করে ফেলেছিলেন। আর যাই হোক, ‘বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী’ তিনি অন্তত দেবেন না।

দলনায়ক টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছেন। দুই উদ্বোধক উড়ন্ত সূচনাই এনে দিয়েছেন। তিন ওভারেই ত্রিশ জমা পড়েছে স্কোর বোর্ডে। চতুর্থ ওভারে আউট হলেন আশরাফুল। এবার ২২ গজের আয়তক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন তিনি। প্রিয় বন্ধু তামিমও ফ্লো পেয়ে গেছেন। এবার হয়তো ভালোই জমবে দু’জনার। সোহেইল তানভীরকে পরপর তিন বলে তিন চার মেরে, বুঝিয়ে দিলেন, আজ দুই বন্ধুতে জমিয়ে দেবেন।

কিন্তু কী যে হলো! তামিম ধুম করে দৌঁড় দিয়ে বিপদ ডেকে আনলেন। টাচ-এ থাকা তামিমের বিদায়ের মতো দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আর সেটা যদি হয় রান আউট? বিরক্তি আর হাহাকার যেনো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

তবে অন্য প্রান্তে তিনি রইলেন তাঁর মতোই। দলনায়ককে সাথে নিয়ে সাহসী লড়াইটা চালিয়ে গেলেন, যতক্ষণ পারলেন। মাস কয়েক আগে, এই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে পরাজয়ের পর, এই দলনায়কই তাঁর বুকে খুঁজেছিল সহানুভূতি! পর্বত প্রমাণ দুঃখে প্রলেপ দিবেন কী, তিনিও দলপতিকে জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত অভিব্যক্তি দিয়েছিলেন! চোখের কোণে চিকচিক করছিল জল, হাত দিয়ে চেপে রেখেছিলেন ঠোঁটের কম্পন। তাঁর সেই চাহনি, সেই বোবা অভিব্যক্তি, কাঁপিয়ে দিয়েছিল কোনো এক পাষন্ডের কঠিন বুকও। পাথুরে চোখেও এনে দিয়েছিল জলচে ছাপ।

তাঁর হয়তো সেসব ভালোই মনে আছে। এবার আর কোনো বেদনা বিষাদের গল্প নয়, কোনো এক আনন্দের উপাখ্যান উপহার দিতে চাইছিলেন হয়তো স্বদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষদের। সেদিনের ইতিহাস সাক্ষী, তিনি তাঁর তরফ থেকে চেষ্টার কমতি রাখেননি মোটেই।

দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় বেধড়ক পেটালেন উমর গুল, সাঈদ আজমলদের। ও প্রান্তে দলনায়ক তাঁকে ছেড়ে গেলেন, অন্য সঙ্গীরাও খুব একটা নির্ভরতা দিতে পারলেন না তাঁকে। কিন্তু তাই বলে তাঁর দৃঢ়চিত্ত মানসিকতা, তাঁর কঠিন সংকল্প একটুও ঢিলে হয়নি। তাঁর দিক থেকে তিনি সর্বোচ্চ উজার করে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাদের সুপারম্যান ০২ পড়ুন

বছরের শুরুতে বিপিএল-এ খেলেছিলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় এক ইনিংস। খুলনা রয়েল বেঙ্গলের হয়ে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে কাঁপিয়ে দেয়া ৪১ বলে ৮৬ রানের ঝকঝকে এক ইনিংসে মাত করেছিলেন মিরপুর। সেই তিনিই যেনো এদিন দেশের জার্সি গায়ে ঋণ শোধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগে ৫৪ বলে ৮৪ রানের ইনিংসে, দলকে চ্যালেঞ্জিং একটা স্কোরই কেবল এনে দেননি, দেশের টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এক ইনিংসের মালিকও বনে গিয়েছিলেন।

আগের ম্যাচে যদি ম্যাককালাম-হন্তারক হোন, তবে এদিন সেই ম্যাককালামই বুঝি ভর করেছিলেন ইমরান নাজির-এ। জীবন পাওয়া ইমরান নাজিরের বেধড়ক পিটুনীতে বাংলাদেশের বড় স্কোরটাও কেমন মামুলি হয়ে গিয়েছিল।

তবে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। বোলারদের রান উৎসবে যোগ না দিয়ে, নিরাসক্তের মতো তিনি ৪ ওভার বোলিং করে দিয়েছিলেন মাত্র ২৩ রান! পুরো চার ওভারে একবারই তাঁর বলকে সীমানা ছাড়া করতে পেরেছিলেন ব্যাটসম্যান। অমন কিপটে বোলিংয়ের পরও, সতীর্থদের রান বিলানোর মচ্ছবে তাঁকে ফিরতে হয়েছিল শূণ্য হাতে।

ব্যাটে-বলে এই নিঃসঙ্গ লড়াইগুলো হারিয়ে যায়। আড়ালে চলে যায়। আঁধারে ঢেকে যায়। দিনশেষে পরে থাকে কেবল পরিসংখ্যান। যেখানে জয় আর পরাজয় ব্যতীত কিচ্ছু লেখা থাকে না। পরাজিতদের গল্পগুলো, কীর্তিগুলো, বীরত্বগুলো বাতিলের খাতায় জায়গা পায়। পৃথিবী গায় শুধু জয়ীদের জয়গান।

আমাদের সুপারম্যান  ০৩ পড়ুন!

তবে তিনি এমনই ব্যতিক্রম যে, পরাজিত হয়েও আলোটা তাঁর দিকে ঠিকই টেনে নেন। নিঃসঙ্গ লড়াইয়েও সতীর্থদের জন্য রেখে যান, আগামী দিনের লড়াইয়ের পাথেয়।

আমরা তাঁর এই একাকী লড়াই দেখি, উপভোগ করি, কখনো আনন্দ পাই, কখনো হাহাকার করি। কিন্তু দিনশেষে স্বীকার করি, ক্রিকেট জাতি হিসেবে আমরা আসলেই ভাগ্যবান। আমরা তাঁকে পেয়েছি। রক্তমাংসের একজন সুপারম্যান পেয়েছি।

আইটি প্রতিদিনের সাথেই থাকুন। আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ভিজিট করুন।

Related Posts

Leave a Comment