মাইকেল বেভান: দ্য ফিনিশার

by admin
62 views

মাইকেল বেভান: দ্য ফিনিশার

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ‘ফিনিশার’ টার্মটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ফিনিশারের কাজ হচ্ছে ফিনিশিং অর্থাৎ খেলা শেষ করে আসা। আর ফিনিশিং যদি হয় একটা শিল্প, তবে নিঃসন্দেহে সেই শিল্পের ভ্যান গঘ বা পিকাসো হলেন মাইকেল বেভান।

ক্রিকেটে ফিনিশার তত্ত্বের প্রবর্তন হয়েছে বেভানের হাত ধরে। প্রচন্ড উত্তেজনা আর চাপের মুহূর্তেও মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচ বের করে আনতে পারাটা ছিল তাঁর বিশেষ ক্ষমতা। নিশ্চিত হেরে যাওয়া অনেক ম্যাচও প্রতিপক্ষের হাতের মুঠো থেকে ছিনিয়ে এনেছেন, নিজের অসামান্য ফিনিশিং দক্ষতার গুণে।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, “Cometh the hour, cometh the man.” দল যখন ভয়ানক বিপদে কিংবা চাপে থাকত, বেভানের সেরাটা বেরিয়ে আসত ঠিক তখনই।

**********

‘তথাকথিত’ বিগ হিটার না হয়েও যে ওভার প্রতি আস্কিং রেট ৭-৮ রান করে নেওয়া যায় সেটা বেভানই সর্বপ্রথম দেখিয়েছিলেন। দ্রুত রান তোলার তাড়া যতই থাকুক, কখনও অহেতুক ঝুঁকি নিতেন না। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়ে রানের অনবরত চাকা সচল রাখতেন। আবার আস্কিং রেট যেন নাগালের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য সময়মত ‘ক্যালকুলেটিভ রিস্ক’ নিতেও ভুলতেন না।

মাসল পাওয়ার নয়, বেভানের সাফল্যের রহস্য ছিল টেম্পারমেন্ট আর মেন্টাল স্ট্রেংথ। চাপকে সামলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা — এই দুটো জিনিসই তাঁকে আর দশটা সাধারণ প্লেয়ার থেকে আলাদা করেছিল।

**********

উইজডেনের বিচারে ওয়ানডের সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকায় ‘তিন’ নম্বরে থাকা এই বাঁহাতি লিজেন্ডকে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত সেভাবে মনে রাখবে না। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, অবসর নেয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে ওয়ানডেতে বেভানের গড়টাই (৫৩.৫৮) এখনও অব্দি সেরা। সাকসেসফুল রান চেজে মাইকেল বেভান এর ব্যাটিং গড় ৮৬.২৫ যা ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের (অন্যজন মাইক হাসি) মধ্যে বেভান একজন যার ক্যারিয়ার গড় কখনোই ৪০ এর নিচে নামে নি!

লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে কমপক্ষে দশ হাজার রান করা প্লেয়ারদের মধ্যে বেভানের গড়টাই (৫৭.৮৬) সর্বোচ্চ। বেভানের ফার্স্ট ক্লাস এভারেজও (৫৭.৩২) দুর্দান্ত! অনেক গ্রেট ব্যাটসম্যানেরও ফার্স্ট ক্লাসে এত ভাল গড় নেই।

**********

রঙিন জার্সিতে উজ্জ্বল বেভান টেস্টে ছিলেন নিতান্তই সাদামাটা। টেস্ট গড় মাত্র ২৯.০৭! কোন সেঞ্চুরি নেই, ফিফটি মাত্র ৬টা।

টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল দুর্দান্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেকেই খেলেছিলেন ৮২ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস। প্রথম তিন টেস্টে তিন ফিফটিতে ব্যাটিং গড় ছিল ৬০.৭৫। তবে শুরুটা ভাল করেও পরে আর সেটা ধরে রাখতে পারেন নি। শর্ট বলের দুর্বলতাটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছিল। ক্যারিয়ারের শেষ ৬ টেস্টে মাত্র ৮.১৮ গড়ে করেছেন ৯০ রান!

মাইকেল বেভান এর ব্যাটিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর বোলিং প্রতিভার কথা ভুলে যান অনেকেই। বেভান ছিলেন একজন ‘more than useful’ চায়নাম্যান বোলার এবং দারুণ অ্যাথলেটিক ফিল্ডার। বাঁহাতি রিস্ট স্পিনে ওয়ানডেতে ৩৫টি এবং টেস্টে ২৯টি উইকেট আছে তাঁর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একবার বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচও জিতিয়েছেন!

**********

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেভান কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছেন তাঁর দুর্দান্ত সব ফিনিশিং এবং ম্যাচ সেভিং নকের জন্য। আজ আপনাদের শোনাব সেইসব কালজয়ী ইনিংসের গল্প।

৭৮*, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সিডনি, ১৯৯৬

বৃষ্টির কারণে কার্টেল ওভারে নেমে আসা ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৩ ওভারে ১৭৩। তবে একটা সময় সেই মামুলি টার্গেটই মনে হচ্ছিল এভারেস্টসম। বৃষ্টিভেজা সিমিং উইকেটে ওয়ালশ, অ্যাম্ব্রোসদের সামনে রান তোলা দূরে থাক, উইকেটে টিকে থাকাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

মাইকেল বেভান যখন ক্রিজে নামলেন, দলের স্কোর ৩২/৪! ডানহাতি পেসার ওটিস গিবসনের ‘জোড়া আঘাতে’ মুহূর্তের মধ্যেই সেটা রূপ নিল ৩৮/৬!

তারপর ইয়ান হিলিকে নিয়ে ৩৬ রানের একটা মাঝারি জুটি গড়লেন বেভান। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার একটা প্রচেষ্টা আর কি! হিলি (১৫) যখন বিদায় নিলেন, জিততে হলে তখনও লাগে ৯৯ রান; হাতে আছে আর মাত্র ৩ উইকেট।

এত রান তো আর একা একা করা সম্ভব না! একজন সঙ্গীও যে চাই পাশে। বেভানকে সঙ্গ দিতে তাই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন পল রাইফেলও। অষ্টম উইকেটে দুজনে মিলে গড়লেন ৮৩ রানের এক অনবদ্য জুটি। এদিকে মাত্র ১০ রানের ব্যবধানে রাইফেল (৩৪) আর ওয়ার্ন (৩) ফিরে গেলে আবারও জমে ওঠে খেলা!

অফ স্পিনার রজার হার্পারের করা ম্যাচের অন্তিম ওভারের শেষ বলে দরকার ছিল ৪ রান। বাউন্ডারি হাঁকানোর জন্য মাঠের সবচেয়ে নিরাপদ অঞ্চলটিকেই বেছে নিলেন বেভান। স্ট্রেইট বাউন্ডারি! এত জোরে বোলার’স ব্যাক ড্রাইভ করলেন যে ফিল্ডাররা একটু নড়বার সুযোগও পেল না!

প্রায় ১৫০ মিনিট ক্রিজে থেকে ৬ বাউন্ডারিতে সাজানো বেভানের ৮৮ বলে ৭৮* রানের ইনিংসটিকে এককথায় বলতে হবে ‘প্রাইসলেস’! অনেকের মতে এই ইনিংসটাই ছিল বেভানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট।

*******

৬৯, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, চণ্ডীগড়, ১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল

১৯৯৬ সালের ১৪ মার্চ, উইলস বিশ্বকাপের ২য় সেমিফাইনাল। রিচি রিচার্ডসনের ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছিল মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়া।

টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং কলাপ্সের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। ইয়ান বিশপ আর কার্টলি অ্যাম্ব্রোসের আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে মাত্র ১৫ রান তুলতেই হারায় ৪ উইকেট!

আউট হওয়া চার ব্যাটসম্যানের স্কোর ছিল যথাক্রমে মার্ক টেলর ১, মার্ক ওয়াহ ০, রিকি পন্টিং ০, স্টিভ ওয়াহ ৩!

ঠিক এমন সময় দৃশ্যপটে বেভানের আবির্ভাব। পাঁচে নামা স্টুয়ার্ট ল’কে সাথে নিয়ে ১৩৮ রানের ‘ম্যাচ সেভিং’ পার্টনারশিপ গড়ে দলকে টেনে তুললেন খাদের কিনারা থেকে।

বেভানের ব্যাট থেকে আসলো ১১০ বলে ৬৯ রানের দায়িত্বশীল এক ইনিংস। ৪ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটাকে পরিস্থিতি বিচারে বলতে হবে গ্রেট নক।

বেভানের ৬৯, স্টুয়ার্ট ল’র ৭২ আর হিলির ৩১ রানের সুবাদে অস্ট্রেলিয়া দাঁড় করিয়েছিল ৮ উইকেটে ২০৭ রানের সম্মানজনক স্কোর।

২০৮ রানের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল ৪১ ওভারে ১৬৫/২। শেষ ৯ ওভারে লাগে মাত্র ৪৩ রান, হাতে আছে ৮ উইকেট। নিশ্চিত জেতা ম্যাচটা হাতছাড়া করে শেষ পর্যন্ত ৫ রানে অবিশ্বাস্যভাবে হেরেছিল উইন্ডিজ। মাত্র ৩৭ রানে হারিয়েছিল শেষ ৮ উইকেট!

*******

❐ ৭৯* বিপক্ষ পাকিস্তান, মেলবোর্ন, ১৯৯৭

টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। কিন্তু ডানহাতি পেসার অ্যান্থনি স্টুয়ার্টের বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ২৯ রান তুলতেই তারা হারিয়ে বসে ৫ উইকেট!

পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম ৬ ব্যাটসম্যানের ৫ জনই হয়েছিলেন স্টুয়ার্টের শিকার! নড়বড়ে শুরুর পরেও ইনজামাম-উল-হক (৬৪), ওয়াসিম আকরাম (৩৩), শহীদ আফ্রিদি (৩০) ও সাকলাইন মুশতাকের (২৯*) ব্যাটে চড়ে ঘুরে দাঁড়ায় পাকিস্তান। ৫০ ওভার শেষে তাদের স্কোর দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ১৮১ রান।

১০ ওভার বল করে ইনজামাম ও আফ্রিদির উইকেটসহ ৩৬ রানে ৩ উইকেট নেন ‘চায়নাম্যান’ বোলার মাইকেল বেভান। আর পাকিস্তানের টপ অর্ডার ধসিয়ে দেয়া অ্যান্থনি স্টুয়ার্টের বোলিং ফিগারটা ছিল দেখার মত, ১০-১-২৬-৫!

টার্গেট ১৮২ রান। জবাব দিতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা হয়েছিল একদম বাজে। ওয়াসিম আকরামের জোড়া আঘাতে মাত্র ১১ রানেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান দুই ওপেনার মার্ক টেলর (৮) ও গ্রেগ ব্লিউয়েট (২)। এরপর ক্রিজে আসেন মাইকেল বেভান। স্টিভ ওয়াহ (২০) আর স্টুয়ার্ট ল’কে (২৮) নিয়ে দুটো মাঝারি সাইজের পার্টনারশিপ গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে পুনরায় ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন তিনি।

৩৬ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ১৩৯/৪। ৬ উইকেট হাতে রেখে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ৪৩ রান। ঠিক ওই মুহূর্তে আবারও দৃশ্যপটে হাজির হলেন ‘সুলতান অব সুইং!

অসাধারণ দুটি রিভার্স সুইঙ্গিং ইয়র্কারে তিনি ফিরিয়ে দিলেন ড্যারেন লেহম্যান (১০) ও ইয়ান হিলিকে (০)। খানিকক্ষণ বাদে আফ্রিদির গুগলিতে এলবিডব্লু হয়ে ফিরে গেলেন শেন ওয়ার্নও (২)।

১৩৯/৪ থেকে ১৪৮/৭ — অস্ট্রেলীয় শিবিরে হঠাত করেই জেঁকে বসেছে হারের শংকা। একদিকে ওয়াসিম (৪/২৫), আরেকদিকে ওয়াকার (১/৩৬)! দুই রিভার্স সুইং আর্টিস্ট রীতিমতো ত্রাস ছড়াতে আরম্ভ করেছেন।

অ্যান্ডি বিকেলকে (১৬*) সাথে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন ৮ম উইকেট জুটিতে বেভান যোগ করলেন ‘মূল্যবান’ ৩৪টি রান। দুই মুশতাকের স্পিন আর দুই ডব্লুর রিভার্স সুইংয়ের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে খেললেন ১৪২ বলে অপরাজিত ৭৯ রানের মাস্টারক্লাস এক নক। যার ওপর ভর করে ৩ বল বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া।

*******

১০৩, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, সেঞ্চুরিয়ন, ১৯৯৭

সাউথ আফ্রিকার মাটিতে অনুষ্ঠিত সাত ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের ষষ্ঠ ম্যাচে স্বাগতিকদের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ৫ ম্যাচের ৩টিতে জিতে সিরিজে এগিয়ে ছিল অবশ্য সফরকারীরাই।

এই ম্যাচ প্রসঙ্গে যাবার আগে একটু বলে রাখা ভাল, অস্ট্রেলিয়া দলটা তখন যাচ্ছিল পালাবদলের মধ্য দিয়ে। ওপেনার মাইকেল ডি ভেনুটোর অভিষেক হয়েছিল ওই সিরিজেই। নিয়মিত অধিনায়ক মার্ক টেলরকে ২ ম্যাচ পরই ‘ড্রপ’ করে উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলিকে অধিনায়কত্ব দেয়া হয়। অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে তখন খেলানো হত শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে, মিডল অর্ডারে। গ্রেগ ব্লিউয়েট আর মার্ক ওয়াহ ছিলেন ওপেনারের ভূমিকায়।

যাই হোক, টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের ৮১ বলে ৮০ আর ড্যারিল কালিনানের ৯৫ বলে ৮৯ রানের চমৎকার দুটো ইনিংসের সৌজন্যে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে প্রোটিয়াদের সংগ্রহ দাঁড়াল ২৮৪/৭। নব্বই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা ছিল ম্যাচ উইনিং টোটাল।

২৮৫ রানের বিশাল টার্গেট চেজ করতে নেমে শন পোলকের বোলিং তোপে মাত্র ৫৮ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ৫ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইকেল বেভান যখন ক্রিজে আসেন, জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ২২৭ রান। বল আছে ২১৪টি। অর্থাৎ আস্কিং রান রেট ৬ এর ওপরে। এমন পরিস্থিতিতে জয় অসম্ভব না হলেও ম্যাচ বের করে আনার কাজটি যে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

যে দলে মাইকেল বেভানের মত ‘চেজিং আর্টিস্ট’ আছে, তার আবার চিন্তা কিসের! ৮ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় ৯৫ বলে ১০৩ রানের অসামান্য ইনিংস খেলে সেদিন জয়ের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন বেভানই। ৪র্থ উইকেটে স্টিভ ওয়াহকে (১০২ বলে ৮৯) নিয়ে গড়া ১৮৯ রানের জুটিটাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

৬ বল বাকি থাকতে পাওয়া ৫ উইকেটের দুর্দান্ত জয়ে ৪-২ ব্যবধানে সিরিজটাও জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

*******

❐ ৬৫, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, এজবাস্টন, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালকে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে। নখ কামড়ানো উত্তেজনা আর নাটকীয়তায় ভরা ম্যাচের শেষটা তো আপনাদের সকলেরই জানা। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, সুপার সিক্স পর্বের ‘হেড টু হেড’ লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী হওয়ার সুবাদে দুদলের স্কোর সমান অর্থাৎ ‘টাই’ হওয়ার পরেও বাদ পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা, ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া।

টসে হেরে আগে ব্যাটিং করতে নেমে শন পোলক আর অ্যালান ডোনাল্ডের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে খেই হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ১৭ ওভারে মাত্র ৬৮ রান তুলতেই হারিয়ে বসে ৪ উইকেট! সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করেছিল মাইকেল বেভান আর স্টিভ ওয়াহর ৯০ রানের ৫ম উইকেট জুটি।

দলীয় ১৫৮ রানের মাথায় স্টিভ ওয়াহ (৫৬) বিদায় নিলেও শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান বেভান। ৫০তম ওভারে শন পোলকের পঞ্চম শিকারে পরিণত হওয়ার আগে, ৬ বাউন্ডারিতে বেভানের ব্যাট থেকে আসে ইনিংস সর্বোচ্চ ৬৫ রান (১১০ বল)।

ঐতিহাসিক সেই ম্যাচে বাজে শুরুর পরেও যে ২১৪ রানের টার্গেট দিতে সমর্থ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই বেভানের। দুদল মিলিয়ে ম্যাচের টপ স্কোরারও ছিলেন তিনিই। তাই বলা যায়, পরিস্থিতির দাবি মেটানো বেভানের ৬৫ রানের ইনিংসটাই শেষ পর্যন্ত খেলায় ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল।

*******

১৮৫*, বিপক্ষ এশিয়া একাদশ, ঢাকা, ২০০০

২০০০ সালের ৮ এপ্রিল, দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় ‘এশিয়া একাদশ’ বনাম ‘অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের’ প্রীতি ওয়ানডে ম্যাচ।

এশিয়া একাদশের দেয়া ৩২১ রানের বিশাল টার্গেট চেজ করতে নেমে এক পর্যায়ে বিশ্ব একাদশের স্কোর ছিল ৩৭ ওভারে ১৯৬/৭। ঠিক তার পরপরই অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ায় দলটি; বেভান-ক্যাডিক জুটির কল্যাণে।

৮ম উইকেট জুটিতে মাইকেল বেভান আর অ্যান্ড্রু ক্যাডিক মিলে যোগ করেন ১১৯ রান, মাত্র ৭৭ বলে! যে জুটিতে ক্যাডিকের অবদান মাত্র ২৩! আর বেভানের ব্যাট থেকে আসে ১৩২ বলে অপরাজিত ১৮৫ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস! ১৯ বাউন্ডারির সাথে ছক্কা মেরেছিলেন ৫টা!

বেভানের ১৮৫ রানের অনবদ্য ইনিংসটার মাহাত্ম্য বেড়ে যায় বহুগুণে যখন শুনবেন ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল মার্ক ওয়াহর ২৮ রান!

শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২০ রান। এশিয়া একাদশের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম বল তুলে দিলেন আব্দুল রাজ্জাকের হাতে। প্রথম বলেই লেগবাই থেকে এক রান নিয়ে বেভানকে স্ট্রাইক ফিরিয়ে দেন ক্যাডিক। এরপর রাজ্জাককে টানা ৩টি বাউন্ডারি মারেন বেভান।

শেষ ২ বলে প্রয়োজন ৭ রান। ওভারের ‘পেনাল্টিমেট’ বলে দুই রান নিতে চাইলেন বেভান; কিন্তু সময়মত ব্যাট মাটি স্পর্শ না করায় নন স্ট্রাইক এন্ডে রান আউট হয়ে যান ক্যাডিক। উইকেট বড় কথা নয়; রান আউটের কারণে মূল্যবান ১টি রান থেকে বঞ্চিত হয় বিশ্ব একাদশ।

শেষ বলে লাগত ৬, কিন্তু বেভান মারলেন ৪! মাত্র ১ রানের আক্ষেপে পুড়ল অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ!

আইসিসি ম্যাচটার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়নি। মাইকেল বেভানের ওয়ানডে সর্বোচ্চ’এর ঘরেও তাই লেখা নেই অপরাজিত ১৮৫!

*******

❐ ৮৭*, বিপক্ষ ভারত, গোয়া, ২০০১

২০০১ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার সেই ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজের পর দুদল মুখোমুখি হয়েছিল পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে। প্রথম ৪ ম্যাচ শেষে ২-২ ব্যবধানে অমীমাংসিত সিরিজের নিষ্পত্তি হয়েছিল শেষ ম্যাচে। ভেন্যু ছিল নেহেরু স্টেডিয়াম, গোয়া।

টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ভিভিএস লক্ষণের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে (১০৭ বলে ১০১) ভারত করেছিল ৬ উইকেটে ২৬৫ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে গিলক্রিস্টের ৬০ বলে ৭৬ রানের (১০ চার, ১ ছয়) ঝড় অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিয়েছিল ‘ফ্লাইং স্টার্ট’। তবে মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় নিয়মিত বিরতিতে পড়তে থাকে উইকেট। চারে নামা মাইকেল বেভানের ১১৩ বলে ৮৭* রানের ‘ফিনিশিং’ মাস্টারক্লাসে শেষ পর্যন্ত ৪ উইকেট ও ১২ বল হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছায় তারা।

সেদিন অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের মাঝপথ থেকেই প্রচুর টার্ন পেতে আরম্ভ করেন ভারতীয় স্পিনাররা। মন্থর উইকেটে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিং করাটা তাই ক্রমশ দুরূহ হয়ে আসছিল। লেগ স্পিনার টেন্ডুলকার একাই নেন ৩ উইকেট!

৪০তম ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল ২০২/৬। চার উইকেট হাতে রেখে শেষ ১০ ওভারে লাগত ৬৪ রান। উইকেটে বল যেভাবে ঘুরছিল, তাতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ যেকোন সময় ভারতের দিকে ঘুরে যেতে পারত। টার্নিং উইকেটে কোয়ালিটি স্পিনের বিপক্ষে বেভানের অপরাজিত ৮৭ রানের ‘গ্রেট’ ইনিংসটি তাই নিঃসন্দেহে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় ইনিংস।

*******

❐ ১০২*, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, মেলবোর্ন, ২০০২

প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড করেছিল ২৪৫ রান। সেই রান চেজ করতে নেমে বন্ড, ন্যাশ আর অ্যাডামসের তোপে মাত্র ৮২ রান তুলতেই স্বাগতিকরা হারায় ৬ উইকেট!

১৭০ বলে দরকার ১৬৪ রান, হাতে উইকেট আছে মাত্র ৪টা! জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ‘ক্রাইসিস ম্যান’ মাইকেল বেভান যে তখনও ক্রিজে! শেষ পর্যন্ত ৩ বল বাকি থাকতে ২ উইকেটের জয় পায় অস্ট্রেলিয়া; যা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র বেভান ম্যাজিকের কল্যাণে।

সেদিন ছয়ে নামা বেভানের ব্যাট থেকে এসেছিল ৯৫ বলে ১০২ রানের দুঃসাহসিক এক ইনিংস! সপ্তম উইকেটে শেন ওয়ার্নকে নিয়ে ৬১, অষ্টম উইকেটে ব্রেট লি’কে নিয়ে ৭১ আর নবম উইকেটে বিকেলকে নিয়ে গড়েছিলেন ১২ বলে ২৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি। ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়েও দলকে জেতাতে পারেন নি দুর্দান্ত বোলিং করা ফাস্ট বোলার শেন বন্ড। বন্ডেরই শেষ ওভারে মারা ‘জয়সূচক’ জোড়া বাউন্ডারিতে তুলির শেষ আঁচড়টা দিয়েছিলেন অ্যান্ডি বিকেল।

*******

৭৪*, বিপক্ষ ইংল্যান্ড, পোর্ট এলিজাবেথ, ২০০৩ বিশ্বকাপ

২০০৩ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। পোর্ট এলিজাবেথের তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ে সেদিন ছড়িয়েছিল অ্যাশেজের উত্তাপ।

টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে ইংল্যান্ড করেছিল ৮ উইকেটে ২০৪ রান। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ডানহাতি পেসার অ্যান্ডি বিকেল একাই নিয়েছিলেন ৭ উইকেট!

২০৪ রানের মাঝারি পুঁজি নিয়েও সেদিন দারুণ লড়াই করেছিল নাসের হুসেইনের ইংল্যান্ড। ক্যাডিক-ফ্লিনটফ-জাইলসদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে এক পর্যায়ে ৪৮ রানে ৪ এনং ১৩৫ রানে ৮ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া! এমন পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডকে ফেভারিট না ভেবে কোন উপায়ই ছিল না। কিন্তু ‘একজন’ মাইকেল বেভান সেটা ভাবতে দিলে তো!

গিলক্রিস্ট (২২), হেইডেন (১), পন্টিং (১৮), মার্টিন (০), সাইমন্ডসদের (০) ব্যর্থতার দিনে বেভান নেমেছিলেন ৬ নম্বরে, একপ্রান্ত আগলে রেখে উপহার দিয়েছিলেন ১২৬ বলে অপরাজিত ৭৪ রানের টিপিক্যাল বেভান্স নক! ইংলিশ বোলার-ফিল্ডারদের সকল প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে ৯ম উইকেটে বিকেলকে (৩৪*) নিয়ে গড়েছিলেন ৭৩ রানের ম্যাচ উইনিং জুটি! দুই বল বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল ২ উইকেটের নাটকীয় এক জয়!

*******

শুভ জন্মদিন, দ্য ফিনিশার ❤

লিখেছেন: এস. এম. নাহিদ নেওয়াজ

‘আমাদের সুপারম্যান’ নিয়ে পড়তে ক্লিক করুন। আইটি প্রতিদিনের সাথেই থাকুন

Related Posts

Leave a Comment