এন্টিবায়োটিক যুগ, এর ইতিহাস ও কার্যকারিতা~১
এন্টি মাইক্রোবায়াল’রা সম্ভবত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম কার্যকর জীবাণুনাশক। এটা বলার প্রয়োজনই নেই যে, সংক্রামক ব্যাধি দমনে তারা কতোটা কার্যকর ছিলো এবং যেসব রোগব্যাধি মানুষের অস্তিত্বের পথেই বাধা হয়ে ছিলো তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এন্টি মাইক্রোবায়ালস রাই। কিন্তু একটা কমন ভুল ধারণা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। সেটা হলো, এন্টিবায়োটিক যুগ শুরু হয়েছে ১৯২৭ সালে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কার থেকে। কিন্তু তারও আগে প্রাকৃতিক ভাবে অনেক বারই প্রাণঘাতী জীবাণুর বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়া হয়েছে। পুরোনো কংকালের দেহাবশেষগুলি পড়ে রয়েছে সাক্ষী হিসাবে। আনুমানিক ৩৫০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দের রোমান সৈনিকদের দেহে “টেট্রাসাইক্লিন” এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
মিশরের বিখ্যাত ফসিল ‘দাখলেশ’ এর দেহেও “টেট্রাসাইক্লিন” ও “ফ্লুরোক্রোম” এর অস্তিত্ব সন্দেহাতীত। সৈনিকদের খাদ্যাভ্যাসে এসবের অস্তিত্ব প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক এর শক্তিশালী প্রমাণ।এবং সে যুগের মহামারীতে এসব শ্রেণীর মানুষের মৃত্যুহারই সবচাইতে কম। টেট্রাসাইক্লিন হাড়,দাঁত ও পরিপাক জনিত জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ধারণা করা হয় এরকম আরো এন্টিবায়োটিক এর ব্যবহার আগের যুগে ছিলো। কিন্তু সেগুলো সবগুলোর অস্তিত্ব নিরুপণ করা যায় না। জর্ডান বাসীরা ঐতিহ্য গত ভাবেই লাল মাটির ব্যবহার করে যাতে একটিনোমাইসিনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যা ত্বকের যত্নে ও জীবাণু নাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন চাইনিজ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এন্টি মাইক্রোবায়ালস এর নিয়মিত ব্যবহার ছিলো, বিশেষ করে ম্যালেরিয়া দমনে তাদের ব্যবহৃত তিক্ত সোমরসের ব্যবহার উল্লেখ না করলেই নয়। শত মিলিয়ন বছর পুরোনো প্লাসমিডে এখনো ল্যাক্টামিস এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাই এন্টিবায়োটিকের ধারণা নতুন হলেও, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার প্রাণীজগৎ এর ইতিহাসের মতোই প্রাচীন।
আধুনিক এন্টিবায়োটিক যুগের সূচনাঃ আধুনিক এন্টিবায়োটিক যুগের শুরু হ্য পল আরলিচ আর আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং এর হাত ধরে। আর্লিচ এর ম্যাজিক বুলেট আইডিয়া আইডিয়া শুধুমাত্র সেই রোগগুলো টার্গেট করে যা শুধু অনুজীব এর কারণে ঘটে। এবং শুধুমাত্র ক্ষতিকর অনুজীব কেই টার্গেট করবে,পূর্বের এন্টিমাইক্রোবায়াল গুলোর মতো সকল জীবাণু নাশ করবে না। এ কাজে তিনি এনিলিন এবং অন্যান্য সিনথেটিক ডাই এর ব্যবহার করলেন। আর্লিচ এর যুক্তি ছিলো স্পেসিফিক কেমিকেল একটি নির্দিষ্ট ক্ষতিকর জীবাণুকে সম্পুর্নভাবে বিনাশ করে দিতে পারে অন্যান্য অনুজীব এর ক্ষতি না করেই। এই যুক্তিতে তিনি ও তার সহযোগী রা সর্বপ্রথম যৌন সসংক্রামক ব্যাধি সিফিলিস প্রতিরোধে এটোক্সিল যুক্ত যৌগের ব্যবহার শুরু করেন। ১৯০৪-১৯১০ ব্যাপি গবেষণার পরে অবশেষে ৬০৬ নাম্বার যৌগ সিফিলিস প্রতিরোধে সক্ষম হলো। যেটা পরবর্তিতে “নিওসালভারসন” নামে বাজার জাত করা হয়। ঔষধ আবিষ্কারে আর্লিচ এর “সিস্টেম্যাটিক স্ক্রিনিং এপ্রোচ” নতুন দিগন্তের সূচনা করে। যার ফলে প্রায় হাজারখানেক আধুনিক ঔষধ চালু হয় চিকিৎসাক্ষেত্রে। এন্টিবায়োটিক এর শুরুর যুগে আরেকটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা ঔষধ তৈরিতে সালফার এর ব্যবহার। কেমিস্ট জোসেফ ক্ল্যারার ও ফ্রিট মিজ এর প্রোটনসিল এন্টি ব্যাক্টেরিয়াল হিসেবে খুবই কার্যকর ছিলো। আকস্মিকভাবেই এটা আনন্দের সংবাদ হিসেবে আসে যে প্রটোনসিল এর মূল উপাদান সালফানিলামাইড এর আগেই ব্যবহার হওয়ায় এই ঔষধের পেটেন্ট নেওয়া যায় নি। ফলে এই এন্টিব্যাকটেরিয়াল হয় খুবই সুলভ ও সস্তা এবং প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী এন্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এরপরে সালফার হতে আরো কিছু ঔষধ বের হয় কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিকর যে বিষয়টি এতে উঠে আসে তা হলো, এই ঔষধগুলোর ব্যবহারে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসেরও জিনগত উন্নতি সাধন হয় এবং পরবর্তিতে তারা আরো শক্তিশালী রূপে আক্রান্ত করতে সক্ষম হয়।
সত্যি বলতে, ক্ষতিকর প্রাণঘাতী জীবাণু দমনে প্রকৃত এন্টিবায়োটিক এর ব্যবহার তখনো শুরু হয় নি। এ কারণেই আধুনিক এন্টিবায়োটিক যুগের সূচনাকাল ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৮, এবং পূর্বের এতো এতো গবেষণার পরেও আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং কেই এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। পেনিসিলিয়াম নামক ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন পেনিসিলিন নামক বিশ্বের প্রথম এন্টিবায়োটিক। মজার ব্যাপার হলো এই ধর্ম বহুবছর ধরে বহু বিজ্ঞানীর নজরে আসলেও কেউই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন নি এর আগে, পেনিসিলিয়াম ব্যাকটেরিয়া এর আগেও বহু স্যাম্পল ভাইরাস ধ্বংসের পরেও ফ্লেমিং এর আগে কেউই এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাই করেন নি। কিন্তু ফ্লেমিং এর আবিষ্কার এরও সীমাবদ্ধতা ছিলো, পেনিসিলিন এর ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে জানলে এটিকে পরিপূর্ণ ভাবে পেনিসিলিয়াম থেকে পরিশোধন ও ব্যবহার উপযোগী করায় আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং অসমর্থ হন। তিনি তাই সময় মতো এই এন্টিবায়োটিক এর পেটেন্ট নিতে পারেন নি এবং কেমিস্ট দের তার গবেষণায় সাহায্য করতে আহবান করেন। অবশেষে,হ্যাঁ সত্যিকারের সুখবর টা এলো ১৯৪০ সালে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওয়ার্ড ফ্লোরি আর আর্নেস্ট চেইন অবশেষে পেনিসিলিন পরিশোধন করতে পারেন। ৫ বছর ধরে ফ্লেমিং এবং অপর দুইজন এর মাত্রা ও ব্যবহার কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেন এবং পরিমিত মাত্রায় ব্যবহারে সতর্ক করেন সকলকে। শেষমেশ ১৯৪৫ হতে পেনিসিলিন ঔষধ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার শুরু হয়।
এইটুকু হয়তোবা অনেকেরই জানা,কিন্তু একটা মজার ব্যাপার প্রায়ই মানুষের লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। তা হলো হাসপাতাল ব্যবহার উপযোগী,জনসাস্থ্যে প্রয়োগকৃত পৃথিবীর ১ম এন্টিবায়োটিক। যেটার নাম “পায়োসায়ানেজ”, উদ্ভাবন করেন এমরিচ ও লো। ব্যাসিলাস নামক ব্যাক্টেরিয়া হতে এই গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিক এর আবিষ্কার হয়।যা পরবর্তি ৮০ বছরের ইতিহাসে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করবে।
প্রকৃতপক্ষে প্রথমদিককার সালভারসন, প্রটোনসিল, পেনিসিলিন প্রতিটি আবিষ্কারই ধাপে ধাপে এন্টিবায়োটিক যুগের সুচনা করে। যা সম্ভবত বদলে দিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও পরবর্তী বিশ্ব।
(চলবে…)